রাসূলে আকরাম সা: একবার সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, তোমরা মিম্বরের কাছে এসো। এরপর তিনি তিনবার ‘আমিন’ বললেন। সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন ব্যাপার কী? তিনি বললেন আমি জিবরাঈলের দোয়ায় আমিন বলেছি। এরপর তিনি বললেন ১. ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক অর্থাৎ সে ব্যর্থ ও অকৃতকার্য হোক, যার জীবনে রমজান এলো। কিন্তু সে এটির মূল্য দিলো না এবং আল্লাহর ক্ষমা লাভের উপযুক্ত হলো না। ২. আমার নাম উচ্চারণ করা হলো অথচ সে আমার ওপর দুরূদ পাঠ করল না। ৩. যে ব্যক্তি তার মা-বাবা উভয়কে কিংবা যেকোনো একজনকে পেয়েও তাদের খেদমত করে জান্নাত লাভ করতে পারল না।
রমজান এমন সুবর্ণ সুযোগ যে, চেষ্টা করলে এক রমজান মাসই সারা জীবনের গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট। যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে এবং বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহর সব প্রতিশ্রুতি সত্য এবং তিনি সব নেক কাজের জন্য উত্তম বদলা দেবেন, তার জীবনের সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে রোজা রাখবে, তার অতীত জীবনের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
ঈমান ও ইহতিসাবের মর্ম এই যে, আল্লাহ তায়ালার সব প্রতিশ্রুতির ওপর পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে এবং প্রতিটি কাজের সময় ছওয়াবের নিয়ত করতে হবে। ইখলাস, নিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তা থাকবে এবং কাজটি করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টির কথাই চিন্তায় রাখবে। ঈমান ও ইহতিসাবই মানুষের কাজকর্মকে পৃথিবীর মাটি থেকে আল্লাহর আরশে পৌঁছে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এখন এটারই অভাব। মুসলমানদের মূল ব্যাধি অসাধু নিয়ত নয়, বরং নিয়তহীনতা। অর্থাৎ তারা মোটেই নিয়ত করে না। আমরা অজু করি কিন্তু নিয়ত করি না। আমরা ইসলামের অন্যান্য রুকন আদায় করি। কিন্তু ঈমান ও ইহতিসাবের কথা আমরা মনে রাখি না। কোনো কাজ যখন অনেক মানুষে করে, তখন তা প্রথায় পরিণত হয়।
রমজানে এক সাধারণ পরিবেশ বিরাজ করে। কেউ যদি মনে করে, সবাই রোজা রেখেছে, আমি রোজা ছাড়া কাটাই কী করে? তাহলে রোজার প্রাণশক্তি চলে গেল। অসুস্থতার সময়েও খানাপিনা ছাড়া কাটাতে হয়। সফরেও অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু তা রোজা বলে গণ্য হবে না। রোজা নিছক উপোস থাকা নয়। রোজার মর্ম আল্লাহর নির্দেশ পালন, তিনি যেসব বিষয় পরিহার করতে বলেছেন, সেগুলো পরিহার করা। আমাদের প্রথমে এই মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে যে, আল্লাহর তায়ালা সত্য। সাথে থাকবে ছওয়াবের আশা। অন্তরে থাকবে এই সান্ত¡না যে, আমার এ আমলের বিনিময়ে আমি ছওয়াবের অধিকারী হচ্ছি। এই মনোভাব নিয়ে রোজা রাখলে বিশেষ তৃপ্তি ও প্রশান্তি অর্জিত হবে।
কোনো ইবাদতের বিশেষত্ব ও তা কবুলযোগ্য হওয়ার প্রমাণ এই যে, তা পালনের সময় অন্তর বিগলিত হবে, অন্তর নরম হবে এবং বিনয় ও ঈমানের চেতনা সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে যখন অহমিকা ও অহঙ্কার এবং আত্মম্ভরিতা সৃষ্টি হবে, তখন মনে করতে হবে, আমার এই ইবাদত কবুল হয়নি। এতে ত্রুটি রয়ে গেছে। তাই এসব বিষয় মনে রাখা এবং এসব দোষ দূর করার চিন্তা থাকা প্রয়োজন। কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়া বা না বুঝে নিয়ত না করে রোজা রাখা, তেমনি অন্য যেকোনো ইবাদত এভাবে পালন করা অনর্থক। এক ব্যক্তি বলছেন, আমি রোজা রাখি এজন্য যে, ইফতারের সময় যে স্বাদ অনুভব করি, পৃথিবীর কোনো খাবারেই তা পাই না। অথচ লোকটির ঈমান নেই আল্লাহর প্রতি। এজন্য আমাদের উচিত দিনে কয়েকবার নিয়ত সতেজ করা, রোজার উদ্দেশ্য সবসময় স্মরণ রাখা। রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি কাজ তার জন্য এবং সে দশ থেকে সাতশ গুণ সওয়াব পাবে। কিন্তু রোজা আমার জন্য এবং আমিই এটির প্রতিদান দেবো। এই বান্দাহ তার সব প্রিয়বস্তু আমার জন্যই পরিহার করে। তাই আমি নিজেই তার প্রতিদান দেবো।
দ্বিতীয়ত, শরিয়তের যত রুকন রয়েছে সেগুলো শক্তি সঞ্চারিত করে। অর্থাৎ এক ইবাদত আরেক ইবাদতের সহায়ক হয়, অন্য ইবাদতের শক্তি সঞ্চার করে। একটি খাদ্য যেমন অন্য খাদ্যের সহায়ক হয়, তেমনি একটি ফরজ আদায় অন্যান্য ফরজ আদায়ের জন্য সহায়ক হয়, তাতে শক্তি সঞ্চার করে। এমন নয় যে, প্রতিটি রুকন বিচ্ছিন্ন। অবশ্য প্রতিটির আবশ্যিকতা ও গুরুত্ব যথাস্থানে প্রযোজ্য। তবে একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন নয়। বরং একটি অপরটির সহায়তার জন্য। এভাবে রমজানের রোজা বছরের পুরো এগারো মাসের ইবাদতের জন্য শক্তি জোগায়। রোজার কারণে অন্যান্য ইবাদত আদায়ে আগ্রহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় এবং শক্তি পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, রোজার উদ্দেশ্য প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনা। রোজার কারণে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়, শরিয়তের বিধান পালনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়, অন্যান্য ইবাদত পালনের উৎসাহ জন্ম নেয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হলো, যেমন তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের আগে যারা ছিল তাদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)
অর্থাৎ প্রতিটি কাজ করার সময় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির কথা স্মরণ রাখতে হবে। তাকওয়ার অর্থ কেউ কেউ করেছেন লক্ষ রাখা। অর্থাৎ প্রতিটি কাজ করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যে, এই কাজটি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অনুযায়ী হচ্ছে কি না। হালাল ও হারামের যেন পার্থক্য হয়ে যায়। এভাবে অভ্যাস করলে তা স্বভাবে পরিণত হবে। যেমন ঈদের দিনে আপনারা পানাহার করতে গিয়ে ইতঃস্তত করেন। কেননা পুরো এক মাস অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায় দিনের বেলায় পানাহার না করার। আজ তাতে ব্যত্যয় ঘটে। এজন্য এদিন পানাহার করা অভ্যাসের খেলাপ হয়। আর এতেই মনে সংকোচ লাগে। অথচ তা ছিল সাময়িক। তেমনি পাপের কাজ পরিহার, আল্লাহর অবাধ্যতা এড়িয়ে চলা, গীবত, অশ্লীলতা, রাগ, বিদ্বেষ পরিহার করার অভ্যাস স্বভাবে পরিণত হওয়া উচিত। যেগুলো সব সময়ের জন্য হারাম, সেগুলো করতে গিয়ে আরো সঙ্কোচ ও অনীহা হওয়া উচিত। রোজায় জীবনে পরিবর্তন আসা উচিত। রোজা রাখলাম, কিন্তু গালি দেয়া, গীবত করা, অশ্লীলতা, রাগ, বিদ্বেষ ছাড়লাম না, তাহলে রোজার ফল হলো না। প্রকৃতপক্ষে রোজা যেন মুমিনের জীবনে স্পষ্ট পরিবর্তন সাধন করে। রোজার সময় পাপাচার বর্জন করা হয়েছে। এতে অবিচল থাকা উচিত। আর পাপাচার করা যাবে না। রোজার কারণে যেগুলো পরিহার করা হয়েছে, রোজা চলে গেলেই যদি সেগুলো আবার করা হয়, তাহলে প্রমাণিত হবেÑ রোজা রাখা হলেও তা কবুল হয়নি। হজ করা হলেও তা কবুল হয়নি। এমনভাবে রোজা রাখা উচিত যে, একজন অমুসলিম ব্যক্তি দেখলেও বুঝতে পারেনÑ লোকটি সত্যিই রোজাদার এবং এখন রমজান মাস। অতএব রোজার পুরো সম্মান রক্ষা করা প্রয়োজন এবং রোজার সব চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন।
রাসূলে আকরাম সা: এরশাদ করেন, যখন তোমাদের কারো রোজার দিন হয়, তখন সে যেন অশ্লীলতা বা ঝগড়ায় লিপ্ত না হয়। তার সাথে যদি কেউ বিতণ্ডায় লিপ্ত হয়, তাহলে তাকে বলবেÑ আমি রোজাদার। রোজা রেখে প্রবৃত্তির সব দুর্বলতা দূর করতে হবে। রাগ দমন করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ দূর করতে হবে। রোজা এমনভাবে রাখবে না যে, রাগে মুখ লাল করে বসে থাকবে। আর লোকেরা বলবেÑ তার সাথে এখন কথা বলা যাবে না। কেননা তার মেজাজ ঠিক নেই। খাবারে লবণ একটু কম হলেই রেগে তুলকালাম ঘটাবে না। এসব আচরণ পরিহার করতে হবে। যদি রোজার সব চাহিদার প্রতি লক্ষ রাখা হয়, তাহলে তার প্রভাব পড়বে পুরো এগারো মাস এবং রোজাদারের জীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটবে।
চতুর্থত, রোজাকে যেসব বিষয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। রোজার উদ্দেশ্য এই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালার প্রতি যেন বান্দাহর মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। শুধু রোজা রাখা হলো। কিন্তু নেই তেলাওয়াত, নেই সদকা খয়রাত, নেই তারাবি। তাহলে সেই রোজার ফল সামান্যই। বরং রমজানে গুরুত্ব দেয়া দরকার তওবা ইস্তেগফারে। দোয়ায় মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ ও দোয়ায় আত্মনিয়োগ করা প্রয়োজন। কেননা এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষণা হতে থাকেÑ আছে কি আমার কোনো প্রিয় বান্দা, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেবো। মহানবী সা: তাহাজ্জুদে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আত্মনিয়োগ করতেন। বরং তিনি তারাবিহের চেয়ে তাহাজ্জুদেই জোর দিতেন বেশি।
এ মাসে সদকা-খয়রাতের উপরেও জোর দেয়া প্রয়োজন। আল্লাহর রাসূল সা: এই মাসটিকে সদাচার ও সমবেদনার মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ এ মাসে আল্লাহ তায়ালার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হওয়া এবং সদকা-খয়রাতে আরো অংশ নেয়া প্রয়োজন। মানুষের খোঁজখবর নিয়ে তাদের বাড়িতে উপহার ও সহায়তা পাঠানো প্রয়োজন। আল্লাহর এমন অনেক বান্দাহ রয়েছেন, যারা মসজিদে এসে ইফতার করেন। তারা আর কোনো খাবার পান না। তাদের অনাহারে থাকতে হয়। এজন্য এমন অভাবী লোকদের খোঁজ নিয়ে তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন। আল্লাহর রাসূল সা: এটির প্রতি খেয়াল রাখতেন। তার সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়, রমজানে তিনি হতেন সবচেয়ে দানশীল। আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, তিনি মুক্ত বাতাসের চেয়েও দানশীল হয়ে যেতেন। অর্থাৎ তিনি অন্তর খুলে অভাবী, দুস্থ, বিধবা ও এতিমদের সহায়তা করতেন।
মানুষকে বুঝতে হবেÑ আমাদের ইবাদত কতটুকু। আমরা আল্লাহ তায়ালার যথোপযুক্ত ইবাদত করতে পারি না। আমরা ভালোভাবে তওবা ইস্তেগফার করতে পারি না। এজন্য আমাদের উচিত অনাহারী, অসহায় ও দরিদ্রদের সহায়তা করা। তাহলে হয়তো আল্লাহর কোনো বান্দাহর অন্তর খুশি হবে। এতে আল্লাহ তায়ালা তা কবুল করে নেবেন। আর আমাদেরও উদ্দেশ্য সফল হবে। আমাদের ইবাদত, আমাদের তেলাওয়াত, আমাদের নামাজ কবুল হওয়ার যোগ্য নয়। তবে আল্লাহর পথে কিছু অর্থ ব্যয় করলে হয়তো এরই বদৌলতে তিনি সব ইবাদত কবুল করে নেবেন। এজন্য এ মাসে দান সদকার প্রতি পুরো মনোযোগ ও জোর দেয়া প্রয়োজন। তাহলে এ মাসের সুফল পাওয়া যাবে। মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, রমজান মাস শুরু হলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়Ñ হে কল্যাণপ্রত্যাশী, তুমি অগ্রসর হও। আর হে অকল্যাণ প্রত্যাশী তুমি পিছিয়ে যাও।
অনুবাদ : মাওলানা লিয়াকত আলী